উপাখ্যান বা পালাগান যখন ‘যাত্রাপালা’য় রূপান্তর হলো তখন এটি অনন্য রূপ বা শ্রুতিমধুর হয়েছিল। অষ্টম ও নবম শতকে পৌরাণিক কাহিনীকে নানান সাজ-সজ্জা এবং অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে প্রকাশ করাকেই যাত্রাপালা হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়। চর্যাগীতিতেও যাত্রাভিনয়ের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। দ্বাদশ শতাব্দীতে রচিত জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ উপখ্যান বা পালা বলেও মতান্তর রয়েছে। খ্রিস্টিয় চতুর্দশ শতাব্দীতে বাংলা ভাষায় রচিত বড়–চণ্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণ কীর্তন কাব্যে যাত্রা গানের বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। ষোড়শ শতাব্দির প্রথম দশকে আনুমানিক ১৫০৭-১৫০৮ খ্রিস্টাব্দে নদীয়ায় শ্রী চৈতন্যদেবের আত্মীয় চন্দ্রশেখরের বাড়িতে রাতব্যাপি কৃষ্ণলীলা অভিনয়ের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়। এমনকি চরিত্রানুযায়ী সাজসজ্জাসহকারে কৃষ্ণলীলা উপস্থাপণ করা হয়েছিল বলেও উল্লেখ আছে। ধারণা করা হয় বঙ্গদেশে এটাই ছিল যাত্রার আদি এবং উৎপত্তিকাল। পরবর্তীতে ষোড়শ শতাব্দীর প্রথম দশকে ‘রুক্ষিনী-হরণ’ নামে যাত্রাপালায় শ্রী চৈতন্যদেব নিজে অভিনয় করেন। ধারণা করা হয় শ্রী চৈতন্যদেবের হাতেই কৃষ্ণযাত্রা একটি বিশেষ মাত্রা লাভ করে।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের সাড়ে তিন দশক পর ইংরেজশাসিত বঙ্গদেশে বাংলা নাট্যাভিনয়ের সূচনা করেন রুশ নাগরিক হেরাসিম লেবেডেফ। সে সময়ে গ্রামে-গঞ্জে সারা রাত যাত্রাগানের আসর বসত। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে বীরভূম জেলার কেঁন্দুলী গ্রামের শিশুরাম অধিকারী যাত্রাগানে এক নতুন মাত্রা সংযোজন করেন। ভক্তি রসাত্মক ভাবধারার মাধ্যমে যাত্রার নতুন জাগরণ নিয়ে আসেন তিনি। যাত্রাগানের ইতিহাসে তিনি ‘নবযাত্রার পথিকৃৎ’ হিসেবে পরিচিত। শিশুরামের পর সপ্তদশ শতাব্দীতে পরমানন্দ অধিকারী ও গোবিন্দ অধিকারী বিভিন্ন আঙ্গিকে, যাত্রাকে বিন্যাস ও রূপকল্পে আরও সময়োপযোগী করে তোলেন। ভাব-বিন্যাসে এবং হৃদয়ের গভীরতায় কৃষ্ণযাত্রার নতুন রূপায়ণ দেখা যায়। উনিশ শতকের মাঝামাঝিতে নবদ্বীপের কৃষ্ণকমল গোস্বামী এ ধারাকে আধুনিকায়ন হিসেবে প্রবর্তন করেন। ঢাকা শহরের প্রথম যাত্রাপালা মঞ্চায়ন হয় কৃষ্ণকমল গোস্বামীর ‘স্বপ্নবিলাস-১৮৬১’। কৃষ্ণকমল গোস্বামীর ৩টি পালা ‘স্বপ্নবিলাস-১৮৭২’, ‘দিব্যোন্মাদ-১৮৭৩’ ও ‘বিচিত্র বিলাস-১৮৭৪’ খুব সুনামের সাথে মুদ্রিত হয় এবং পাঠক সমাদৃত হয়। কৃষ্ণকমলের আগে আর কারো পালা মুদ্রিত আকারে প্রকাশিত হয়নি।
আষ্টাদশ শতকে যাত্রাপালা বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ সময় শিশুরাম, পরমানন্দ অধিকারি, সুবল দাস ছিলেন যাত্রা জগতের বিখ্যাত নাম। পরবর্তীতে উনবিংশ শতকে পৌরাণিক কাহিনী ভিত্তিক যাত্রা খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। মতিলাল রায় ও নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়ের যাত্রাদল প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে। তারা কৃষ্ণলীলা, রামায়ণ, মাহাভারতের পাশাপাশি বিদ্যাসুন্দর, বেহুলা লখিন্দর, মা মনসা, লক্ষীর মহিমা, কমলা সুন্দরীর মতো ধর্মীয়, লোকজ কাহিনী যাত্রাভিনয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে খুবই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। (চলবে)