বর্তমান সময়ে ডিভোর্স বা বিবাহবিচ্ছেদ সমাজে এক সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগের দিনে এই শব্দটি উচ্চারণ করতেও মানুষ সংকোচ বোধ করত। কিন্তু এখন তা যেন দৈনন্দিন বাস্তবতার অংশ হয়ে গেছে। বিশেষ করে শহুরে জীবনে প্রতিদিন অসংখ্য দাম্পত্য সম্পর্ক ভেঙে যাচ্ছে। এর ফলে কেবল দু’জন মানুষের সম্পর্কই ভাঙছে না; বরং সন্তান, পরিবার, এমনকি সামগ্রিক সমাজ ব্যবস্থার ওপরও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, দেশে যেমন বিয়ের হার বেড়েছে, তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের হারও ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস–২০২২ অনুযায়ী, ২০২১ সালে সাধারণ বিয়ের হার ছিল ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ, আর ২০২২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ২৫ শতাংশেরও বেশি। তবে এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে তালাকের সংখ্যাও। বাংলাদেশ স্যাম্পল ভাইটাল স্ট্যাটিসটিকস ২০২৩–২৪ অনুযায়ী বিয়ের হার বেড়েছে আরো ৭ শতাংশ এবং বিবাহবিচ্ছেদের সংখ্যাও আগের চেয়ে বেশি। তাদের তথ্য অনুসারে তালাক বা বিবাহবিচ্ছেদের ঘটনা সবচেয়ে বেশি ঢাকা ও সিলেট অঞ্চলে।
ডিভোর্স বৃদ্ধির প্রধান কারণ-
বিবিএস জরিপ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু উল্লেখযোগ্য কারণ হলো—
১. বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক
জরিপে উত্তরদাতাদের ২৩% বলেছেন, পরকীয়া তালাকের মূল কারণ। ঢাকায় এ কারণে তালাকের হার সবচেয়ে বেশি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারও অনেক ক্ষেত্রে পরকীয়াকে সহজ করে তুলছে।
২. দাম্পত্যজীবন পালনে অক্ষমতা
সংসারের দায়িত্ব নিতে না পারা, স্বামী-স্ত্রীর মানসিক অস্থিরতা সম্পর্ক ভাঙনের অন্যতম কারণ। বরিশালে এ কারণে তালাক বেশি হয়।
৩. অর্থনৈতিক চাপ ও ভরণপোষণের অভাব
রাজশাহীতে ভরণপোষণ দিতে অক্ষমতার কারণে তালাকের সংখ্যা তুলনামূলক বেশি।
৪. পারিবারিক হস্তক্ষেপ
ময়মনসিংহে পরিবারের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপ, বিশেষ করে শ্বশুরবাড়ির অনধিকার চর্চা, তালাকের হার বাড়াচ্ছে।
৫. গার্হস্থ্য সহিংসতা ও নির্যাতন
মানসিক, শারীরিক বা আর্থিক নির্যাতনও বিচ্ছেদের অন্যতম কারণ।
৬. যৌন অক্ষমতা বা অনীহা
রংপুরে এ কারণে তালাক তুলনামূলক বেশি ঘটে।
৭. বিদেশে দীর্ঘদিন থাকা
সিলেটে প্রবাসজীবনের কারণে স্বামী-স্ত্রীর দূরত্ব ও সন্দেহ থেকে তালাকের সংখ্যা বেশি।
৮. প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অনেক দাম্পত্য সম্পর্কে ভুল বোঝাবুঝি, অবিশ্বাস ও সন্দেহ তৈরি করছে।
নারীদের মধ্যে ডিভোর্স আবেদন বেশি
________________________________
ঢাকা সিটি করপোরেশনের পরিসংখ্যান বলছে, ডিভোর্স আবেদনের বড় অংশ নারীরা করছেন। ২০২২ সালে ঢাকা দক্ষিণে মোট তালাকের সংখ্যা ছিল ৭,৬৯৮টি। এর মধ্যে স্ত্রীরা আবেদন করেছিলেন ৫,৩৮৩টি, যা প্রায় ৭০ শতাংশ। ঢাকা উত্তরে এই হার ৬৫ শতাংশ।
বাস্তব উদাহরণ
______________
ঢাকার এক স্কুলশিক্ষিকা (নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক) সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগতভাবে জানান—
“আমি সংসারে থাকতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিদিন সন্দেহ, অবমাননা, আর স্বামীর পরকীয়ার কারণে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলাম। অবশেষে তালাকই একমাত্র পথ মনে হয়েছে।”
সিলেটেও সাম্প্রতিক সময়ে এ ধরনের একাধিক ঘটনা ঘটেছে। উদাহরণস্বরূপ—
সিলেট মহানগরের এক প্রবাসী পরিবারের গৃহবধূ জানিয়েছেন, স্বামী দীর্ঘদিন বিদেশে থাকায় দূরত্ব ও সন্দেহের কারণে তাদের সংসার ভেঙে যায়। তিনি বলেন, “প্রথমে ভেবেছিলাম সময়ের সঙ্গে সম্পর্ক আরও দৃঢ় হবে, কিন্তু উল্টো অবিশ্বাস আর একাকিত্ব আমাকে তালাকের পথে ঠেলে দেয়।”
সিলেটের বিয়ানীবাজার উপজেলার এক তরুণী বলেন, “স্বামীর অতিরিক্ত সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার ও অন্য নারীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা আমাদের সম্পর্কে তীব্র দ্বন্দ্ব তৈরি করে। শেষ পর্যন্ত মানসিক নির্যাতনের কারণে তালাকের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হই।”
গোলাপগঞ্জের আরেক নারী স্থানীয় গণমাধ্যমে জানান, “অর্থনৈতিক ভরণপোষণ না পাওয়া এবং শ্বশুরবাড়ির হস্তক্ষেপে সংসার অশান্ত হয়ে ওঠে। তাই নিজের মানসিক শান্তির জন্য তালাকই বেছে নিয়েছি।”
তবে কেবল পুরুষের দোষ দিয়েই ডিভোর্সের কারণ ব্যাখ্যা করা যাবে না। অনেক পুরুষও নারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছেন।
পুরুষদের অভিযোগ (ছদ্মনামে সাক্ষ্য)
_________________________________
“মুফিদুল ” (ছদ্মনাম), সিলেট সদর উপজেলার এক তরুণ ব্যবসায়ী বলেন,
“আমার স্ত্রী সংসারের প্রতি কোনো টান দেখাত না। শুধু টাকা চাইত, বাবার বাড়ির সঙ্গেই বেশি মিশত। আমার প্রতি সম্মান বা ভালোবাসা ছিল না। শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক টেকেনি।”
“ফয়ছল” (ছদ্মনাম), মৌলভীবাজারের এক প্রবাসী বলেন,
“বিয়ের পর বুঝতে পারলাম স্ত্রীর পরিবার আসলে কাবিন ব্যবসা করেছে। কাবিনের টাকা, গয়না আর অন্যান্য সুবিধা নেওয়ার পর থেকেই সংসারে আগ্রহ কমে যায়। এখন শুনছি, ওই মেয়ে আবার অন্যত্র বিয়ে করেছে।”
“রফিক” (ছদ্মনাম), সিলেট শহরের একজন চাকরিজীবী অভিযোগ করে বলেন,
“আমার স্ত্রী আমাকে ছোট ছোট কারণে অপমান করত, সংসারে শান্তি ছিল না। বিয়ের এক বছর যেতে না যেতেই সে বাবার বাড়ি চলে যায় এবং তালাক চায়। আমি বুঝেছি, তার পরিবার আগেই পরিকল্পনা করেছিল কাবিন টাকার সুবিধা নেওয়ার।”
এইসব বাস্তব অভিজ্ঞতা দেখায়—ডিভোর্স কেবল একপক্ষের দায়ে হয় না, বরং উভয় পক্ষের ভুল, লোভ, অবহেলা বা অপব্যবহার মিলিয়েই সম্পর্ক ভাঙনের দিকে যায়।
বিশ্লেষণ
________
এইসব বাস্তব অভিজ্ঞতা প্রমাণ করে যে ডিভোর্স কেবল একপক্ষের দায়ে হয় না। পুরুষের দায়িত্বহীনতা, পরকীয়া, মাদকাসক্তি কিংবা সহিংসতা যেমন সম্পর্ক ভাঙনের কারণ; তেমনি নারীর লোভ, কাবিন ব্যবসা, একাধিক বিয়ের প্রবণতা বা স্বামীর প্রতি মমতার অভাবও পরিবার ভাঙনের জন্য সমানভাবে দায়ী।
প্রতিরোধের পথ বলে হিসেবে উল্লেখিত
_________________________________
বিয়ের আগে পরিবার ও উভয় পক্ষের মধ্যে খোলামেলা আলোচনা এবং মানসিক প্রস্তুতি থাকা জরুরি।
পারিবারিক দ্বন্দ্ব সমাধানে উভয় পক্ষের ধৈর্য, শ্রদ্ধা ও সহমর্মিতা অপরিহার্য।
সমাজে সচেতনতা বাড়াতে হবে যেন কেবল অর্থ বা কাবিন ব্যবসার জন্য বিয়ে না হয়।
ধর্মীয় ও সামাজিক মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিতে হবে।
সতর্কতামূলক নোট-
এই লেখার উদ্দেশ্য কোনো একপক্ষকে দায়ী করা নয়; বরং বাস্তবতার ভিত্তিতে নারী-পুরুষ উভয়ের অভিযোগ, অভিজ্ঞতা ও সমস্যার চিত্র তুলে ধরা। ডিভোর্স প্রতিরোধে সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়া জরুরি—কারণ একটি সংসার ভাঙলে ভেঙে যায় একটি পরিবার, ভেঙে যায় আগামী প্রজন্মের স্বপ্ন।
লেখক
মোঃ মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী
গবেষক, কলামিস্ট, সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মী।
ইমেইল: pressmuazzambd@gmail.com