রিপোর্ট সোহাগ নিজস্ব প্রতিবেদক:-
অদ্য ১৩ মে মঙ্গলবার সকাল ১০.০০ সময় হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের বলরুমে প্লাস্টিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উদ্ভাবন ও সেরা চর্চার প্রসার’ শীর্ষক এই কর্মশালাটি যৌথভাবে আয়োজন করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউট (IMS), আরণ্যক ফাউন্ডেশন, ও রেড অরেঞ্জ লিমিটেড। এতে অংশ নেন দেশি-বিদেশি বিভিন্ন খাতের অংশীজনরা। যারা কমিউনিটি-ভিত্তিক, উদ্ভাবনী প্লাস্টিক বর্জ্য সমাধানে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, উপদেষ্টা, সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়।
এছাড়াও আরো উপস্থিত ছিলেন, ড. ফাহমিদা খানম, অতিরিক্ত সচিব, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়। গ্লোবাল নেতৃত্ব থেকে গোয়েন লুইস (জাতিসংঘ আবাসিক সমন্বয়কারী), গেইল মার্টিন (বিশ্ব ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত কান্ট্রি ডিরেক্টর), এবং সুধীর মুরলিধরণ (UNOPS কান্ট্রি ম্যানেজার)।
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, ‘অনেকেই বলেন আমি শুধু পলিথিন নিয়ে কথা বলি। আসলে সব ধরণের সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিক আমাদের শারীরিক ক্ষতির পাশাপাশি পরিবেশগত দিক থেকেও অনেক ক্ষতি করছে। ফলে আমাদের এ দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমাদের পূর্বপুরুষদের সময়ের কথা যদি চিন্তা করি, তারা কি এভাবে পলিথিন, প্লাস্টিকের জিনিস ব্যবহার করতেন? এখন তো প্লাস্টিকের বদলে অনেক ধরণের জিনিস তৈরি হয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করতে পারি।’
বুড়িগঙ্গার নীচে কয়েক ফুট শুধু প্লাস্টিকের স্তর আছে- এমনটা জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘ঢাকার কয়েকটি খাল উদ্ধার করে পুরনো চেহারায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এর মধ্যে একটি খাল আছে কেরাণীগঞ্জের শুভাঢ্যা খাল নামে পরিচিত। অনেক টাকায় খাল উদ্ধার করতে হবে দেখে সিদ্ধান্ত নিলাম, আগে খালটি সরেজমিন দেখে পরে ফাইল স্বাক্ষর করবো। গিয়ে দেখলাম খালের অস্তিত্ব নেই। এটাকে প্লাস্টিকের খাল বলা যায়। বুড়িগঙ্গা খননের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখানে কমপক্ষে পাঁচ ফুট প্লাস্টিকের স্তর। এগুলো তোলার যন্ত্র নেই। বিআইডব্লিউটএ একটি যন্ত্র আনার চেষ্টা করছে। নভেম্বরে হয়তো আসবে। কিন্তু এত প্লাস্টিক উঠিয়ে কোথায় রাখবো?’
জুস খাওয়ায় সাধারণত ব্যবহার হওয়া স্ট্র-এর উৎপাদন বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হবে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জুলাই থেকে আমরা এর উৎপাদন বন্ধে কাজ করতে চাই। পলিথিনের বদলে পাটের ব্যাগ তৈরি করে সুলভমূল্যে গ্রাহককে দেওয়ার চিন্তা করা হচ্ছে। কারণ সুপার শপে গিয়ে অনেকে বেশি দাম দিয়ে একটি ব্যাগ কিনতে চান না। সরকারি অনেক দফতরে এখন সিঙ্গেল ইউজ প্লাস্টিকের ব্যবহার কমে আসছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, ‘এটাও কিন্তু এক ধরণের সফলতা। সরকারি দফতরগুলোর বাইরেও অনেক জায়গায় এসব প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ হয়ে আসছে। সুপার শপগুলোতে পলিথিনের ব্যবহার বন্ধ করা সম্ভব হয়েছে।
আঞ্চলিক প্রচেষ্টা, স্থানীয় প্রভাব:
প্রকল্পটি একটি আঞ্চলিক উদ্যোগ যা বাস্তবায়ন করছে সাউথ এশিয়া কোঅপারেটিভ এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম (SACEP), এবং এটিতে সহযোগিতা করছে বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের প্রজেক্ট সার্ভিস অফিস (UNOPS)। বাংলাদেশে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের দিকনির্দেশনায় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে এবং আজকের কর্মশালাটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মেরিন সায়েন্স ইনস্টিটিউট (IMS), আরণ্যক ফাউন্ডেশন, ও রেড অরেঞ্জ লিমিটেড।
বাস্তব সমাধান, বাস্তব প্রভাব:
শহরাঞ্চলে জলাবদ্ধতা রোধে ভাসমান প্লাস্টিক ব্যারিয়ার, সুন্দরবনে বায়োডিগ্রেডেবল পণ্যের কেন্দ্র, এবং রিয়েল-টাইম প্লাস্টিক ট্র্যাকিং অ্যাপের মতো উদ্ভাবনসমূহ কর্মশালায় প্রদর্শিত হয়েছে, যা ইতিমধ্যেই উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলেছে:
• চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের IMS উপকূলীয় অঞ্চলে ‘সার্কুলার ইকোনমি’ মডেল চালু করে পরিত্যক্ত মাছ ধরার জাল সংগ্রহ ও ২০,০০০টির বেশি পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদন করছে এবং অনেক মানুষকে ইকো-এন্টারপ্রাইজে প্রশিক্ষণ দিচ্ছে।
• রেড অরেঞ্জ লিমিটেড ঢাকার কল্যাণপুর খালে ভাসমান ব্যারিয়ার স্থাপন করে ইতিমধ্যে ৬৫ মেট্রিক টনের বেশি বর্জ্য সংগ্রহ করেছে এবং আইওটি প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্লাস্টিক দূষণ ট্র্যাক করছে।
• আরণ্যক ফাউন্ডেশন সুন্দরবনে প্রথমবারের মতো প্লাস্টিক অডিট চালু করেছে এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক বর্জ্য খাতকে ডিজিটাল করার জন্য মোবাইল অ্যাপ ও নারী-অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
সমগ্র বাংলাদেশে প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৩,৮৪,০০০ কেজি প্লাস্টিক বর্জ্য অপসারণ, ২৫০টি কর্মসংস্থান সৃষ্টি, এবং ২,৩৬৬ জন বর্জ্য কর্মীকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় এক-তৃতীয়াংশই নারী।
ভবিষ্যতের পথনির্দেশনা:
কর্মশালায় অংশগ্রহণকারীরা এই মডেলগুলো সারাদেশে ছড়িয়ে দেওয়ার বিভিন্ন পথ নিয়ে আলোচনা করেন। তাদের সুপারিশগুলো ছিল:
• স্মার্ট সিটি পরিকল্পনায় প্লাস্টিক বর্জ্য ট্র্যাকিং অন্তর্ভুক্ত করা।
• বর্জ্য সংগ্রাহকদের জন্য জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির আওতায় আনয়ন।
• বিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রমে প্লাস্টিক সংক্রান্ত শিক্ষা যুক্ত করা।
রেড অরেঞ্জ লিমিটেড-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক অর্ণব চক্রবর্তী বলেন:
“যা কাজ করে, আমরা তা প্রসারে প্রস্তুত — পরিষ্কার নদী, উপকূল ও কমিউনিটি যেন স্বপ্ন নয়, বরং জাতীয় মানদণ্ড হয়।”
ড. মো. আবদুল মোতালেব, আরণ্যক ফাউন্ডেশনের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক, সমাপনী বক্তব্যে বলেন:
“এই সমাধানগুলোকে পাইলট পর্যায়েই থামিয়ে রাখা যাবে না। নিরবিচ্ছিন্ন সহায়তা থাকলে, এগুলো সারাদেশে পরিবর্তন আনতে পারবে।”