শিমুল রেজা নিজস্ব প্রতিবেদক:-
১৯৬৮ সনে ইংরেজরা এ দেশ ছেড়ে যাওয়ার পর কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (পাকিস্তান) লি. এর স্থলে ব্যবস্থাপনা দায়িত্ব ইপিআইডিসির ওপর ন্যস্ত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর প্রতিষ্ঠানটি জাতীয়করণ করা হয়। তখন থেকে অদ্যাবধি এটি কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লি. নামে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনে পরিচালিত হয়ে আসছে। দেশের একমাত্র লাইসেন্সধারী অ্যালকোহল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোম্পানি ২০২৪-২৫ অর্থ বছরে মদ বিক্রি করে ১১৫ কোটি টাকা লাভ করেছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ৪৩৮ কোটি ৯১ লাখ টাকার মদ বিক্রি করেছে, যা কোম্পানির ইতিহাসে সর্বোচ্চ বিক্রির রেকর্ড। দর্শনা কেরু এ্যান্ড কোম্পানির যাত্রা শুরু হয় ১৯৩৮ সালের দিকে প্রতিষ্ঠিত দেশের সবচেয়ে বড় চিনিকল দর্শনা কেরু অ্যান্ড কোম্পানি। চিনি উৎপাদন কারখানা,ডিস্টিলারি, জৈবসার কারখানা, -পরীক্ষামূলক খামার ও ডিস্টেলারি কারাখানার সমন্বয়ে গঠিত বৃহৎ এ শিল্প কমপ্লেক্সের চিনি কারখানাটি দীর্ঘদিন ধরে অব্যাহতভাবে লোকসান গুনে আসছে।ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাব্বিক হাসান যোগদানের পর থেকে কিছুটা ঘুরে দাঁড়িয়েছে চিনি কারখানাটি।কৃষক কিভাবে লাভবান হবে সেই হিসাবে গুনগত মান রেখে তৈরি হলো জৈব সারখানা এ জৈব সার ব্যাবহার করে বর্তমান কৃষকরা ভালো রেজাল্ট পাচ্ছে, আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে সারা বাংলাদেশে এই জৈব সারখানা তেও লাভের মুখ দেখছে। এ সবের পিছনে যার অবদান রয়েছে তিনি হলেন, কেরু এন্ড কোম্পানির জনপ্রিয় মুখ সুযোগ্য ম্যানেজিং ডিরেক্টর রাব্বিক হাসান। যোগ্যতা মেধা দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কেরু এ্যান্ড কোম্পানি কিভাবে লাভবান হবে কি করলে কেরু বাঁচবে তার চিন্তা চেতনা শুধু কেরু এ্যান্ড কোম্পানি কে নিয়ে।
অনুসন্ধান,
শিল্প মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) একডজনেরও বেশি প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করে। এরমধ্যে অধিকাংশই চিনি কল। যেখানে ২০২৪-২৫ অর্থবছরে চিনি কলগুলোর ৬০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে, সেখানে দর্শনা কেরু ছিল একমাত্র লাভজনক প্রতিষ্ঠান।
মন্ত্রণালয় থেকে ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবর প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদনে বিভিন্ন কর্পোরেশনের অধীনে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানগুলোর আর্থিক তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিএসএফ আইসির অধীনে ১৫টি চিনিকলের এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি ৭৮ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে জয়পুরহাট চিনিকলে।এই লোকসানের জন্য বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করা হয়েছে। যার মধ্যে আখ চাষ কমে যাওয়া, কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি, চিনির বিক্রয়মূল্য উৎপাদন খরচের তুলনায় কম থাকা এবং ঋণের ব্যয় বৃদ্ধি অন্যতম কারণ।
কেরু অ্যান্ড কোম্পানির প্রধান পণ্য চিনি। তবে আখ থেকে চিনি নিষ্কাশন করার পর বিভিন্ন উপজাত পণ্যও (বাই-প্রোডাক্ট) উৎপাদন করা হয়। যেমন— মদ, ভিনেগার, স্পিরিট এবং জৈব সার।প্রতিষ্ঠানটি দেশীয় মদ, পরিশোধিত স্পিরিট উৎপাদন করে থাকে। পাশাপাশি, দুই প্রকার ভিনেগার— মল্ট ভিনেগার এবং সাদা ভিনেগারও তৈরি করে থাকে।এর কারখানাগুলোর সম্মিলিত বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ১.৩৫ কোটি প্রুফ লিটার।কেরু অ্যান্ড কোম্পানির ডিস্টিলারি ইউনিটে রয়েছে ৯ প্রকারের মদ— ইয়েলো লেবেল মল্টেড হুইস্কি, গোল্ড রিবন জিন, ফাইন ব্র্যান্ডি, চেরি ব্রান্ডি, ইম্পেরিয়াল হুইস্কি, অরেঞ্জ কুরাকাও, জারিনা ভদকা, রোসা রাম এবং ওল্ড রাম।১৮০ মিলি, ৩৬৫ মিলি এবং ৭৫০ মিলির বোতলে মদ বিক্রি করে কেরু। সম্প্রতি প্রতিষ্ঠানটির সবগুলো নির্ধারিত গুদামে চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছে।কর্মকর্তারা জানান, প্রতিটি কেসে ৭৫০ মিলির ১২ বোতল, ৩৬৫ মিলির ২৪ বোতল বা ১৮০ মিলির ৪৮ বোতল মদ থাকে।
প্রতিষ্ঠানটির ডিস্টিলারি ইউনিটের কর্মকর্তারা জানান, চলতি ২০২৪ সালের জুন নাগাদ কেরুর স্পিরিট এবং অ্যালকোহল উৎপাদন সামান্য বেড়ে ৬০ লাখ প্রুফ লিটারে পৌঁছেছে। ২০২৩ অর্থবছরে যা ছিল ৫৯ লাখের চেয়ে একটু বেশি। ‘প্রুফ’ শব্দটি অ্যালকোহলযুক্ত পানীয়ের মধ্যে অ্যালকোহল উপাদানের পরিমাপ বোঝাতে করতে ব্যবহৃত হয়।চুয়াডাঙ্গার দর্শনায় অবস্থিত দেশের একমাত্র লাইসেন্সধারী ডিস্টিলারি প্রতিষ্ঠান কেরু অ্যান্ড কোম্পানি (বাংলাদেশ) লিমিটেড তার বার্ষিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত এটিই কেরুর চিনিগুড়া থেকে উৎপাদিত সর্বোচ্চ পরিমাণ স্পিরিট এবং অ্যালকোহলের উৎপাদন।
ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাব্বিক হাসান বলেন, “যাত্রা শুরুর পর থেকে এত পরিমাণ লাভের মুখ দেখেনি কেরু। গত কয়েক বছরে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় মদের উৎপাদন কিছুটা বেড়েছে।”তিনি বলেন, “কর্পোরেট ট্যাক্সেশনের আগে, কোম্পানির মুনাফা ১১৫ কোটি টাকা ছাড়িয়েছিল; তবে ট্যাক্সের পরে নিট মুনাফা দাঁড়ায় ৮৫ কোটি টাকায়; আগের অর্থবছরে এই মুনাফা ছিল ৬৪ কোটি টাকা।”রাব্বিক হাসানের মতে— ২০২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে, গণ-অভ্যুত্থান এবং রাজনৈতিক ক্ষমতার পট পরিবর্তনের কারণে কেরুর স্পিরিট এবং অ্যালকোহল উৎপাদন সামান্য হ্রাস পেয়েছে।তবে চাহিদা মেটাতে বর্তমানে ডিস্টিলারি ইউনিট সম্পূর্ণ ক্ষমতায় কাজ করছে বলে উল্লেখ করেন তিনি, আরও বলেন ২০২৩- অর্থ বছরে ১১২ কোটি ৭ লাখ টাকা মুনাফা লাভ করেছে। চিনি কলের লোকসান সমন্বয় করা হয়েছে। রেকর্ড পরিমাণ রাজস্ব জমা দেওয়া হয়েছে। গত অর্থ বছরের চেয়ে লাভ হয়েছে ৫৫ কোটি টাকারও বেশি। আখ উৎপাদন ও মিলের উৎপাদন বাড়াতে কাজ করছি নিয়মিত। কৃষকদের আখ চাষে আগ্রহী করে তুলতে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছি।আখের দাম বৃদ্ধি করা হয়েছে। কৃষি খামার ৩২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ লাভের মুখ দেখলো। একমাত্র চিনি কারখানা ছাড়া সব ইউনিট লাভজনক। মদ উৎপাদন ও বিক্রি অনেক বেশি হয়েছে। সবার সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠানটি লাভজনক রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে
জেলায় ৫৫০০ একর জমিতে আখ চাষ হচ্ছে। এর মধ্যে কেরুর নিজস্ব খামারে আখ রয়েছে ১৬২৫ একর। কৃষকরা চাষ করছেন ৩৯৩৭ একর জমিতে। প্রতি মণ আখ কেরু কর্তৃপক্ষ এ অর্থ বছরে ক্রয় করেছে ২৪০ টাকা মণ।
২০২৪-২৫ অর্থ বছরে কেরু এ্যান্ড কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড প্রায় ৭০ হাজার টন আখ মাড়াই করে ৪ হাজার ৪৫২ টন চিনি উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে। ৬৫ কার্য দিবস চিনি উৎপাদনের জন্য চালু ছিলো মাড়াই মৌসুম। চিনি আহরণের হার হয়েছে শতকরা ৫ দশমিক ১০ ভাগ। প্রতিদিন গড়ে ১ হাজার ১৫০ টন আখ মাড়াই করেছর চিনিকলটি। মিল জোনে এবার দণ্ডায়মান আখ রয়েছে ৫ হাজার ১০০ একর জমিতে।এছাড়াও কেরুর জমিতে আখ চাষের সাথে ফসল হিসেবে চাষ করা হয় আলু, মসুর, সরিষা, ধনিয়া ও মিষ্টকুমড়া। চিনি, পরীক্ষামুলক খামার, ডিস্টিলারি, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, ভিনেগার ও জৈব সার উৎপাদন করে থাকে রাষ্ট্রায়াত্ত এ কোম্পানিটি। দেশে কেরুর ১৩টি ওয়্যারহাউস ও ৩টি বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। দর্শনা কেরু এ্যান্ড কোম্পানির শ্রমিক ও কর্মকর্তারা বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় মিলটি লাভজনক অবস্থায় রয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমডি রাব্বিক হাসান স্যার নানা পরিকল্পনা ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। চলতি অর্থবছরের জন্য আখ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা বৃদ্ধি করা হচ্ছে। কৃষকদের উৎসাহিত করতে, আখের দাম বাড়ানো হবে। সামগ্রিকভাবে আখ উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। মিলটি দেশের স্বার্থে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। গত ৩২ বছর পর কৃষি খামার গুলো লাভ করার বিষয়ে জানতে চাইলে
এক কর্মকর্তা বলেন, বিগত বছর গুলোতে আখের সাথে সাথি ফসল করা হতো না। কিন্তু এ বছর আখের সাথে আধুনিক পদ্ধতিতে সাথী ফসল করার করণে সাথী ফসল থেকে অধিক মুনাফা এসেছে এবং বিগত মৌসুমের চেয়ে ২০২৪-২৫ মৌসুমে আখের গড় ফলন একর প্রতি টন বেশি হওয়ায় কৃষি খামারগুলো লাভ করেছে। তিনি আরও বলেন বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক রাব্বিক হাসান আখ চাষে কৃষকদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে, যার ফলে লাভজনক অবস্থায় ফিরে এসেছে কোম্পানিটি। আখের দাম বৃদ্ধি করেছে এবং কৃষকদের উন্নত মানের বীজ, সার ও কীটনাশক সরবরাহ করেছে। এছাড়াও, মাঠ দিবস ও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদের প্রযুক্তিগত সহায়তা দেওয়া হয়েছে। এর ফলস্বরূপ, কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন এবং আখ চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। কেরু এ্যান্ড কোম্পানির এই উদ্যোগের ফলে আখ উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কোম্পানিটি লোকসান কাটিয়ে লাভের পথে এগোচ্ছে।