৮ মাস ধরে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনে নেই কোনো চেয়ারম্যান বা সদস্য। সর্বোচ্চ ৭ সদস্যের এই সংস্থা বর্তমানে পুরোপুরি অচল। নেই সুয়োমোটো তদন্ত, নেই কোনো শুনানি বা সুপারিশমূলক কাজ। চলছে শুধু কাগজে-কলমে অভিযোগ গ্রহণের রুটিন কার্যক্রম। অথচ দেশের প্রতিটি প্রান্তে চলছে নানাভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ—কিন্তু সেসব যেন কেউ দেখার নয়।
ইতিহাস ও পটভূমি
২০০৭ সালে গঠিত হয় জাতীয় মানবাধিকার কমিশন। কিন্তু বিগত ১৬ বছরে এই প্রতিষ্ঠানটি কার্যত ছিল একটি “দাঁতের গোড়ায় ব্যথা” মার্কা অকার্যকর ও অপ্রাসঙ্গিক সংস্থা। কমিশনের অধিকাংশ চেয়ারম্যানই ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত আমলা—নজরুল ইসলাম, নাসিমা বেগম, ড. কামাল উদ্দিন আহমেদ। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মিজানুর রহমান (২০১০–২০১৬), যিনি কিছুটা সক্রিয় ভূমিকায় ছিলেন।
আলোচিত ব্যর্থতা ও নীরবতা
এই দীর্ঘ সময়ে কমিশনের নীরবতা ছিল চোখে পড়ার মতো।
২০১৩ সালের শাপলা চত্বরের রক্তাক্ত অভিযান,
র্যাবের হাতে জামায়াত নেতা ডা. ফয়েজ আহমদের হত্যাকাণ্ড,
পুলিশ হেফাজতে কথিত ক্রসফায়ারে নুরুজ্জামান জনির মৃত্যু,
ডিডিআর হত্যাকাণ্ড,
বিচারবহির্ভূত হত্যা ও গুমের শত শত ঘটনা
এসবের কোনো ঘটনাতেই মানবাধিকার কমিশনের মুখে কোনো উচ্চবাচ্য ছিল না।
আইনি সীমাবদ্ধতা ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ
কমিশনের বড় দুর্বলতা হলো—তাদের হাতে নেই তদন্ত বা শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা।
নেই নিজস্ব ভবন, নেই দক্ষ আইনজীবীর প্যানেল, নেই আর্থিক সুযোগ-সুবিধা।
একটি রাষ্ট্রীয় সংস্থা হয়েও কমিশনকে রাখা হয়েছে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে, যেন এটি রাষ্ট্রের জন্য অতিপ্রয়োজনীয় নয়।
বিশ্লেষক ও মানবাধিকারকর্মীদের মত
ব্যারিস্টার আবু সায়েম, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের মানবাধিকারবিষয়ক উপদেষ্টা, বলেন:
“কমিশনে দলীয় আমলাদের বসিয়ে এটি দলকানা ও অকার্যকর করে রাখা হয়েছে। এখন সময় এসেছে আইন সংস্কারের এবং আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, সাহসী ব্যক্তিদের মাধ্যমে কমিশনকে ঢেলে সাজানোর।”
মানবাধিকার সংগঠন লাইট হাউসের আহ্বায়ক এম সাইফুল্লাহ বলেন:
“বাজেট, ভবন, জনবল থাকলেও মানবাধিকার কমিশনের কার্যক্রম নেই বললেই চলে। আমরা চাই একটি সাহসী, উদ্যোগী ও জনগণের পাশে দাঁড়ানো কমিশন।”
সরকারি সচিব ড. হাফিজ আহমেদ চৌধুরী স্বীকার করেন:
“নতুন নিয়োগের বিষয়ে এখনো বলার মতো অগ্রগতি নেই।”
বাস্তব চিত্র ও পরিসংখ্যান
২০২৪ সালে মোট অভিযোগ জমা পড়ে ৭৫১টি
২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত জমা পড়ে ৩০০টির বেশি অভিযোগ
সবকিছু থেমে আছে, কারণ চেয়ারম্যান ও সদস্য কেউই নেই।
মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার নতুন আহ্বান
বাংলাদেশ জাতীয় মানবাধিকার সমিতির চেয়ারম্যান মো. মঞ্জুর হোসেন ঈসা, মহাসচিব এডভোকেট সাইফুল ইসলাম সেকুল ও সাংগঠনিক সম্পাদক লায়ন আল আমিন এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন:
“জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের স্থবিরতা, সরকারের উদাসীনতা ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে এটি একটি গুরুতর চার্জশিট। আমরা মনে করি, এই কমিশনকে স্বাধীন, সাহসী ও জনমুখী প্রতিষ্ঠানে রূপান্তর করা সময়ের দাবি। শহীদ আবু সাইদ, মুগ্ধ, ওয়াসিম, ফাইয়াজদের রক্তের উপর দাঁড়িয়ে নতুন বাংলাদেশ গড়ে উঠছে। কিন্তু বিগত ১৬ বছর সবচেয়ে বেশি কেড়ে নিয়েছে মানুষের অধিকার। সেই অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য একটি শক্তিশালী মানবাধিকার কমিশন এখন সময়ের দাবি।”
এখন সময় এসেছে মানবাধিকার কমিশনকে বাস্তবিক অর্থে কার্যকর ও জবাবদিহিমূলক একটি সংস্থায় রূপান্তরের।
কমিশনের নেতৃত্বে আসুক নিরপেক্ষ, সাহসী ও মানবাধিকার চর্চায় অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা—যাঁরা শুধু অভিযোগ গ্রহণই নয়, প্রতিকারের পথে সাহসী পদক্ষেপ নিতে পারবেন।