Crime News tv 24
ঢাকামঙ্গলবার , ৫ আগস্ট ২০২৫
  1. অন্যন্য
  2. অর্থনীতি
  3. আন্তর্জাতিক
  4. খেলা
  5. জাতীয়
  6. দেশজুড়ে
  7. ধর্ম
  8. ফিচার
  9. বাংলাদেশ
  10. বিনোদন
  11. মতামত
  12. রাজনীতি
  13. রান্না
  14. রাশিফল
  15. লাইফস্টাইল
আজকের সর্বশেষ সবখবর

৩১জুলাই থেকে ৩৬ জুলাই কি হয়েছিলো কুষ্টিয়া।

admin
আগস্ট ৫, ২০২৫ ৬:৪৭ অপরাহ্ণ
Link Copied!

 

চিতা বিশ্বাস নিজস্ব প্রতিবেদক:-

আমার দেখা ৫ আগষ্ট স্বাধীনতার দিন। ৫ আগষ্টের স্মৃতিচারণ

গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছে। শরীরটা বেশ ক্লান্ত। ঘুমিয়ে পড়া দরকার। বৃষ্টিতে আবার ঘুম বেশ জমে। বাড়তি যদি থাকে মাথার উপরে টিনের চাল তাহলে তো সোনায় সোগাগা। তার আগে নামাজ পড়ে নেয়া দরকার। আপাতত গামছা গায়ে জড়িয়েই পড়ে নিলাম এশার নামাজটা। বিছানার দিকে যেতেই সবুজা আপা বললো, মিয়ে ভাই কথা বলবে, ফোন দিতে বলছে। মিয়ে ভাই মানে কবি রহমান মাজিদ ( রহমান মা‌জিদ) ।
আমি বললাম -কেন কি হয়েছে? কিছু বলছে নাকি?
আপা- ঢাকা যেতে বললো তোকে এখন। কথা বলে দ্যাখ।
হ্যাঁলো মিয়ে ভাই-
ল- কি অবস্থা? কোথায় আছিত তুই? কুষ্টিয়ার কি অবস্থা?
এই তো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তোর কি অবস্থা? কুষ্টিয়ার অবস্থা কি? এই তো মিছিল করে আসরের সময় বাসায় আসলাম। আজ অনেক লোক হয়েছিলো। বিশাল মিছিল। সব শ্রেণীর লোকের সমাগম হয়েছিল। পোলাপান তো দুই দুইবার পুলিশের উপরে ইট পাটকেল ছুঁড়েছে আজ। শেষে পুলিশ পিছু হঠতে বাধ্য হয়েছে। আমরা শান্তিপূর্ণ ভাবেই মিছিল করছিলাম। দুপুর ১ টার পর পর পুলিশ কুষ্টিয়া মডেল থানার দিকটা থেকে টিআরসেল ছোঁড়ে। তখন মিছিল ছত্রভংগ হয়ে যায়। আমরা চলে আসি। পরে গ্রাম গঞ্জের থেকে কিছু লোক আর কুষ্টিয়ার স্থানীয় কিছু বাসিন্দা মিলে আন্দোলন চালিয়ে গেছে। শুনলাম বিকেলের দিকে পুলিশ মাফ চেয়েছে। আমার মনে হয় এ সরকার আর টিকবে না রে। আবার কাল যাবো ইনশাআল্লাহ।
– নাহ, সরকার টিকার আর কোন সম্ভাবনা নাই। আমি আজ এখানে ( বড় ভাই ঢাকা থাকেন) গিয়েছিলাম। বাবুরা তো যেতে দিবেই না। রিমি, মাইশা, শাদীদ যে কান্না। আমি আর পিছনে না তাকিয়ে চলে গেছিলাম।
– কখন আসলি?
– আমি বিকাল করেই আসলাম। কাল তো প্রধান সমন্বয়করা লং মার্চ টু ঢাকা ডাকছে। ওরা বলছে প্রতিটা পরিবার থেকে অন্তত ১ জন করে হলেও কাল আপনারা ঢাকা আসেন। আমিও এখান থেকে যাবো। তুই এখনই ঢাকা চলে আয়। কাউকে সাথে নিয়ে বাসে করে চলে আয়। হয়তো কাল সব শাহবাগ থেকে এক হয়ে গণভবন ঘেরাও করবে। কাল কিছু একটা হয়ে যাবে।
– এত রাতে কিভাবে যাবো এখন ? বৃষ্টি হচ্ছে। আর গাড়ি পাবো না। আর কার সাথেই বা যাবো।
– দ্যাখ তোরা বাস ভাড়া করে চলে আসতে পারিস নাকি।
– ওরা তো আবার ১৪৪ ধারা জারি করে রাখছে।
কি করি।
– ওটা ভেংগেই তো আসতে হবে। কারফিউ ভাংলেই তো হাসিনার পতন। এজন্যই লং মার্চ টু ঢাকা।
– আচ্ছা আমি একটু কথা বলে দেখি। তোকে জানাচ্ছি একটু পর।
কথাগুলো শেষ করে আমি তুহিনের সাথে কথা বলি। তুহিন আমার সাথেই ছিল। তুহিন কথা বলে জানালো যে, ভাইকে বল, ভাইরা ওখান থেকে যাক। আমরা কাল জেলা দখল করবো। সব চলে গেলে জেলা দেখবে কে?
তখন ভাইকে জানিয়ে দিলাম কথাটা।

৫ আগষ্ট।
আজ সেই ঐতিহাসিক ৫ আগষ্ট।
কবি বলেছেন, এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার সময় তার।
কিশোর-কিশোরী, যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ নারী-পুরুষ, জীবনের মায়া ত্যাগ করে নিজের জানটাকে বাম হাতের মুঠির ভিতরে ভরে ডান হাতে আত্মরক্ষার জন্য তিতুমীরের বাঁশের লাঠি নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। তারা কি সেদিন জানতো যে অল্প কিছু সময়ের মধ্যেই তারা ইতিহাস হয়ে যাবেন? তারা একটা বিপ্লব ঘটাবেন? ১৭ বছর ধরে মাটির গভীরে শেকর গাড়া স্বৈরাচারের পতন ঘটাবেন?

সকাল বেলা সবুজা আপা আমাদের জন্য খাবার রেডি করে দিলো। আমি আর তুহিন তড়িঘড়ি কয়েক লোকমা ফ্যাণা খিচুড়ি মুখে খেয়ে নিলাম। আমরা জানতাম এটাই হয়তো আমাদের জীবনে শেষ খাওয়া। মা’র কাছ থেকে ক্ষমা চেয়ে নিলাম। আব্বাকে দোয়া করতে বললাম। মুখে সাহস দেখিয়ে বিদায় দিরেও আব্বা আর মায়ের চোখে এক সমুদ্র পানি দেখেছিলাম। কয়েকজনকে ফোন দিলাম সাথে যাওয়ার জন্য। এর মধ্যে নওশাদ, মেহেদী, সাকিল, সাব্বিরও চলে আসলো। নওশাদকে জানালাম তুই রেডি হয়ে স্কুলের এইদিকে আগায়ে আয়। আমরা যাওয়ার সময় তোদের নিয়ে যাবো। যেহেতু রাস্তায় রাস্তায় পুলিশ শক্ত অবস্থানে আছে। তাই আমরা বিভিন্ন জায়গাতে ফোন দিয়ে প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নিই।
তুহিনের পরামর্শক্রমে আমরা প্লান করলাম, যেহেতু আমরা জোতপাড়া আছি, এখান থেকে সাতপাখিয়া হয়ে ঘাসখালের ভিতর দিয়ে কুমারখালি বাস স্ট্যান্ড যাবো। ওখান থেকে নছিমন বা আলম সাধুতে করে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালে গিয়ে উঠবো।

বেলা ১১:৩০ টায় মিছিল বের হওয়ার কথা। আমরা সবাই যথাসময়ে কুষ্টিয়া সদর হাসপাতালের সামনে যে ছোট্ট করিডোরটা আছে সেখানে অবস্থান নিলাম। আশে পাশের গ্রাম এলাকা থেকেও কিছু আম জনতা এসে জড়ো হয়েছে সেখানে। যেহেতু পুলিশের কঠোর নজরদারি ছিল তাই আমরা রোগীর স্বজন সেজার একটা ভাব ধরলাম। মিছিল শুরু হলে এখান থেকে দ্রুত মিছিলে ঢুকেরপড়া যাবে।
কিছুক্ষণ পরে হাসপাতালের মেইন গেটে সবাই একত্রিত হলাম। আমাদের নেতৃত্বে থাকলো, সমন্বয়ক মোস্তাফিজুর, সাচ্চু, নয়ন হেসেন রবিনসহ আরো কয়েকজন। আমরা একটু সামনে আগালাম। এই সময়ের মধ্যে আমরা আশে পাশের গাছপালা থেকে ডাল ভেংগে নিলাম নিজেদের প্রতিরক্ষার জন্য। আমরা আমাদের মিছিলটা সাজিয়ে নিলাম, ফ্রন্ট লাইনে থাকলো তুহিনসহ একটা গ্রুপ। যাদের হাতে ছিল তিতুমীরের সেই বাঁশের লাঠি। তার পরের ফ্রন্টে থাকলো আমাদের বোনদের একটা গ্রুপ। এখানে আমার আর আরিফ ভাইয়ের দায়িত্ব ছিল মেয়েদের এই লাইনের মধ্যে যেন কোন ছেলেরা চলে আসতে না পারে এবং লাইনগুলো সুশৃঙ্খল থাকে। এর পরেই ছিল যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলো তাদের রিক্সা। তারপর ছিল আমজনতা।
আমরা মিছিল নিয়ে মেইন সড়কে উঠলাম। মজমপুর গেটে তখন পুলিশও দাঁড়িয়ে গেল আমাদের দিকে তাদের রাইফেল তাক করে।
সমন্বয়ক মোস্তাফিজুর আমাদের নির্দেশ দিলো আপনারা কেউ উচ্ছৃঙ্খল হবেন না। গতকাল পুলিশ আমাদের কাছে ক্ষমা চেয়েছে। তারা আমাদের কথা দিয়েছে, তারা আমাদের শান্তিপূর্ণ মিছিলে কোন ঝামেলা করবে না। আপনারা সবাই শান্ত থাকুন।

আহারে, শিরায় শিরায় যাদের ফ্যাসিবাদের রক্ত চলাচল করে তারা কি কখনো কথা রাখে? অন্তিম সময় নিশ্চিত জেনে কেউ কি তার তলোয়ার কোষবদ্ধ করে? সম্ভবত পুলিশও বুঝে গেছিলো শেষ পরিণতি। তাই তো তারা আমাদের সেই শান্তিপূর্ণ মিছিলে অতর্কিতে টিআরসেল ছোঁড়া শুরু করে দিলো।
মূহুর্তের মধ্যে সবাই ছত্রভংগ হয়ে গেলো। যেই সময় পৃথিবীর এক প্রান্তে ইজরায়েল ফিলিস্তিনের ভূখন্ডে বোমা বর্ষণ করছে। ফিলিস্তিনের আকাশ ইজরায়েলের বোমার আঘাতে সাদা হয়ে গেছে। ঠিক সেই একই সময়ে বিশ্বের মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলাতে আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পালিত পুলিশলীগ বাহিনীর টিআরশসেলে কুষ্টিয়ার আকাশটা সাদা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন হয়ে গেলো। শুরু হলো ইতিহাসের এক করুণ অধ্যায়ের।
যে যার মতো ছুটে পালাতে থাকলো, তখন আমি চলে এসেছিলাম একদম সামনের কাতারে। চারিদিকে মনে হচ্ছে শীতের কুয়াশা ঘেরা। কয়েকবার কালেমা পড়ে নিলাম। ক্ষমা প্রার্থনা করলাম মহান রবের দরবারে। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছিলো। আমি তাকাতে পারছিলাম না। শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চেষ্টা করছিলাম চোখটা খুলে একটু ফাঁকা জায়গা দেখে চলে যাবো। কিন্তু সেই শক্তি আমার তখন ছিলো না। সেই সাথে আমার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল। কাশিতে গলা আটকে এসেছিল। আমি তখন বেঁচে থাকার আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছি। মায়ের কথা আমাকে খুব মনে পড়ছিল। আল্লাহর কাছে বলছিলাম, হে আল্লাহ আমার লাশটা আমার বাবা মায়ের কাছে পৌঁছিয়ে দিও। আর আমার মৃত্যুটা শহীদী মৃত্যুতে কবুল করে নিও। সেই সাথে কালেমা পড়েই যাচ্ছি।
এভাবেই একটা পর্যায়ে চলে আসি একটা বাড়ির গেটের কাছে। আকুতি করে বলেছিলাম প্লিজ গেটটা খুলুন, সেদিন সেই আকুতি হয়তো বাড়িওয়ালার হৃদয়স্পর্শ করেনি। তারা গেট খোলেনি। অগত্যা টিআরসেল লাগার কথা জানিয়ে একটা দিয়াশলাই চাইলাম। এক ভাই তখন একটা দিয়াশলাই হাতে দিলে তখন তার আগুনে আমি স্বাভাবিক হই। সেই সাথে আশে পাশে যারা আমার মত ভুক্তভোগী ছিলো তাদের সাহায্যে এগিয়ে গেলাম। মোটামুটি আমরা সবাই সুস্থ হলাম।
তখনও ঐ রাস্তায় ধোঁয়ার কুন্ডলী। সেটা থেকে পরিত্রাণ পেতে দশ বারোজন লোক আগুন জ্বালানোর চেষ্টা করছিল। তাদের অবস্থাও ঠিক আমার মতোই। কিন্তু ওরা দিয়াশলাই খুঁজে পাচ্ছিল না। আমিও গিয়ে লোকগুলোর সেই চেষ্টা সফল করার কাজে হাত লাগালাম। কিন্ত আগুন জ্বলছিল না কারণ আগের দিন রাতে বৃষ্টি হওয়াতে সবকিছু ভেজা ছিল।
মিনিট পনের পরে আমি সেখান থেকে পিছনে যেয়ে জেলা স্কুলের সামনে চলে গেলাম আমাদের সাথীদের কাছে। ছত্রভঙ্গ দলটি তখন জেলা স্কুলের সামনে জড়ো হয়েছে। সেখানে দেখলাম তুহিন দাঁড়িয়ে আছে। তারপর থেকে আমরা বাকি সময় একসাথেই থাকি দুজন। এর মাঝে তুহিন আর আমি সাক্ষাৎহীন থেকেছি হয়তো ৩০-৪৫ মিনিটের মতো। এই সময় ও কোথায় ছিল, কি করছিল তা আমরা একসাথে থেকেই করেছি।

আসলে জগতে সবাই স্বার্থপর নয়। দুনিয়াতে এখনো কিছু ভালো মানুষ আছে। তাদের জন্যই হয়তো এই দুনিয়াটা এখন পর্যন্ত টিকে আছে। সময়ে সময়ে এই উদার মনের মানুষগুলো আল্লাহ আমাদের সাহায্যের জন্য পাঠিয়ে দেন। টিআরসেলের গ্যাসে যখন চোখ মুখ জ্বলে যাচ্ছিলো তখন প্রথম বাড়ির গেট না খুললেও পাশের গলি দিয়ে একটা বাড়িতে ঢুকে পড়ি। একটা বোন কে বললাম, আপা আমার পেস্ট লাগবে। মনে পড়ে আমার এখনো, সেই বোন দৌড়ে পাশের একটা বাড়ি থেকে একটা ফ্যামিলি সাইজ পেপসুডেন্টের টিউব এনে দিলো আমাকে। কত ভালোবাসা, কত স্নেহ, মনে হয়েছিল এটা আমার আপন বোন, ছোট ভাই পড়েছে বিপদে আর বড় বোন ভাইয়ের কষ্টে অস্থির হয়ে উঠেছে। এই ভালোবাসা, এই সহযোগিতা কোন আর্থিক স্বার্থের জন্য নয়। এটা নিহায়েত একটা অবরুদ্ধ দেশকে স্বাধীন করতে আসা মুক্তিবাহিনীকে উৎসাহ দেবার মানবিক প্রচেষ্টা। আজন্মকাল আমার হৃদয়পটে খোদাই থাকবে সেই স্মৃতি। একটা বিপ্লবীকে বোনের সাহায্য।
মুখে পেস্ট লাগিয়ে রাস্তায় চলে আসি আর বাকি পেস্টটা পকেটে রেখে দিই।
বান্দার বিপদে আল্লাহ কোথা থেকে তার সাহায্য পাঠিয়ে দেন তা বান্দার পক্ষে বোঝা বড় মুশকিল। হঠাৎ দেখতে পেলাম জিলা স্কুলের ভিতর থেকে একজন সেনা অফিসার হ্যান্ডমাইক হাতে এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। আমি কিছুটা ভড়কে গেলাম। আশার কথা, তিনি আমার ধারণার বিপরীত কথা বললেন। তিনি জানালেন ‘ আপনাদের ভয়ের কিছু নেই, আমরা আপনাদের সাথে আছি। আপনারা ভয় পাবেননা।
কেন যেন সেদিন সেনাবাহিনীকে আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। আমি ভাবছিলাম সেনাবাহিনী কি আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে নাকি?
অবশ্য এর পিছনে কয়েকটা কারণ ছিলো।
প্রথমত, সেনাপ্রধান ওয়াকার সাহেব নিজেই যেখানে হাসিনার বসানো লোক। তার খাঁস লোক ছাড়া তো তাকে ঐ পদে রাখেনি। তাহলে সে কিভাবে তার বিরোধী হলো? তার উপরে ৩ তারিখে ঢাকায় ছাত্রজনতার মিছিলে গুলি চালিয়েছে এই সেনাবাহিনী। তারা জাতিসংঘের দেয়া লগোযুক্ত গাড়ি ব্যাবহার করেছে আন্দোলন দমনে। তাহলে কি এর মধ্যে কোন বড় ধরনের ষড়যন্ত্র আছে?

দ্বিতীয়ত , সেনাবাহিনী আমাদের সেখানে আটকিয়ে রাখলেও পাশে বগ চত্বর এর দিকে ছাত্রলীগ আর পুলিশ আমাদের আন্দোলনরত ভাইদের উপর তখনও গুলি করছিল নির্বিচারে। অথচ সেখানে ঐ মুহুর্তে সেনাবাহিনী কোন পদক্ষেপ নিচ্ছিল না।
তৃতীয়ত, আমার এটা মনে হয়েছিলো যে, হয়তো সেনাবাহিনী কৌশলে পুলিশ কে সাথে করে আমাদের ঘেরাও করে তারা একটা ম্যাস কিলিং করতে পারে।

পরে অবশ্য সেনাবাহিনী আমাদের কিছু বলেনি, আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা যখন খুব বেশি বাড়াবাড়ি করছিলো তখন সেনাবাহিনী আমাদের জানায়, আপনারা প্লিজ ধৈর্য ধরুন, সেনাপ্রধান শেখ হাসিনার সাথে কথা বলছেন। আপনারা ২ টা পর্যন্ত অপেক্ষা করুন। আশা করা যায় ভালো সংবাদ পাবেন।
এর মধ্যে আমরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে যোহরের নামাজ আদায় করে নিলাম।
টিক টিক করে ঘড়ির কাটা ১ টা বেজে ২ টার দিকে আগাচ্ছে, আর আমরা ততই উত্তেজিত হয়ে যাচ্ছি। না জানি কি হয়।
ঐ দিকে বগ মোরের দিকে তখনও পুলিশ আর ছাত্রলীগের গুন্ডারা আমাদের ভাইদের উপর গুলি চালিয়ে যাচ্ছিল। আমরা বাধ্য হয়ে সেনাবাহিনীকে সাথে নিয়ে সামনের দিকে আগাতে থাকি। পুলিশ তখনো আমাদের উপর আবার টিয়ারগ্যাস ছোঁড়ে। এতে সেনাবাহিনীর কিছু সৈনিক সামান্য আহত হয়। তখন তুহিনকে বললাম চল সামনে যাই? তুহিন জানালো, নাহ! সামনে যাওয়া যাবে না। এখন বিজয়ের শেষ মুহুর্তে এসে কেন জীবন দিতে যাবো? আর আমি আমার বাপের বড় ছেলে। এখন আমার কিছু হয়ে গেলে আমার পরিবারের কি হবে? এখন সামনে যাবো না। এখন নিজেকে নিরাপদ রেখে কাজ করতে হবে। এখন মরে লাভ নেই। আমি থ মেরে গেলাম ওর কথা শুনে।
সেনাবাহিনী আবার আমাদের নিয়ে পিছনে চলে আসে।

এর মাঝেই একজন সেনা কনস্টেবল গালে গুলিবিদ্ধ হয়। এটা যেন তখন আগুনে পেট্রোল ঢালার মতো কাজ হলো। ছাত্রজনতা রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়লো। তারা সেনাদের কাছে জানতে চাইলো, আপনারা গুলি খাওয়ার পরও কেন চুপচাপ আছেন? তারা আমাদের আবার শান্ত করতে চেষ্টা করে।

অবশেষে এলো আমাদের সেই খুশির সংবাদ। শুধু এমন একটা খবর পাওয়ার জন্য এই ছাত্র জনতা ৩৬ টা দিন নিজেদের জীবন বাজি রেখে রাজপথে লড়েছে। হাজার হাজার ছাত্র নিজেদের জীবনটা বিলিয়ে দিয়েছে রাজপথে। হাজার হাজার মানুষ জীবনের মত পঙ্গুত্ব বরণ করেছে এরিমধ্যে। শুধু একটা স্বৈরাচারকে চেয়ার থেকে নামাতে।
খুনি, স্বৈরাচার, ফ্যাসিষ্ট হাসিনা পালিয়েছে।

এর মধ্যে কবি রহমান মাজিদের সাথে যোগাযোগ রাখছি, তার কিছুক্ষণ আগেই তিনি আমাকে জানিয়েছেন হাসিনা পালিয়েছে। তারা এখন প্রায় পঁঞ্চাশ লক্ষ লোক নিয়ে শাহবাগ থেকে গণভবনের দিকে যাচ্ছে। মনটা বেশ প্রফুল্ল হয়ে উঠলো। এরকম সুখানুভূতি এর আগে কখনও হয়ে বলে মনে পড়ে না।
আমরা মজমপুরের দিকে আগাচ্ছি। কিছু পুলিশ তখনও মজমপুর গেটে অবস্থান করছিল। আন্দোলনরত ছাত্রজনতা তাড়া করে তাদের। রেলের পাথর ছুঁড়তে থাকি আমরা। মজমপুর গেট ছাত্রদের দখলে চলে আসে। তখন অনেকেই বিজয় মিছিল শুরু করে দেয়। সাধারণ জনতা আমাদের সাথে চলে আসে অনেকেই।
এর মধ্যে অনেকেই পুলিশের একটা বাইক নিয়ে এসে সেটা ট্রাফিক বক্সে রেখে আগুন লাগিয়ে দেয়। ট্রাফিক অফিসে ভাংচুর করে। ভিতরের কাগজগুলো এনে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুজিবের ছবি ছিঁড়ে ফেলে । লীগের তৈরি গেটও ভেঙ্গে দেয়।
এটা ছিল আমার জীবনের একটা চরম মুহুর্ত। আল্লাহ আমাদের উপর তার রহমতের বৃষ্টি বর্ষণ করলেন। আমরা মন ভরে বৃষ্টিতে ভিজলাম। বেরিকেড তৈরি করলাম পুলিশ লাইনের সামনের রাস্তায়। যাতে এই পথে সন্ত্রাসী পুলিশ আবার আসতে না পারে। সাথে সাথে আমি আর তুহিন খুশিতে সিজদা করলাম বৃষ্টি ভেজা রাস্তায়। আহ, আজাদির গন্ধ নাকে আসলো আমার। আমরা স্বাধীন হলাম। ভাবতেই খুশিতে মনটা নেচে উঠলো।

৪ টার মতো বাজে। হঠাৎ করেই আমাদের উপর নেমে আসলো বিষাদের ছায়া, আমরা সেই আনন্দটা খুব বেশি সময় ধরে রাখতে পারলাম না। বগ চত্ত্বর থেকে মডেল থানার পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে চলে আসে মজমপুর গেটে। ৪ টা থেকে ৪:৪৫ পর্যন্ত চলে তাদের শেষ তান্ডব। এ যেন একদল বুনো মহিষের মরণ উন্মাদনা। উম্মাদের মতো গুলি করে যাচ্ছে ওরা।
তাদের নেতৃ পালিয়েছে। তারা এখন তাদের জীবন নিয়ে শঙ্কায়। আমরা আবার পিছু হটে চলে আসি জেলা স্কুলের সামনে। সেনাবাহিনীকে বলি পদক্ষেপ নিতে। সেনাবাহিনী আমাদের জানায়, আপনারা একটু ধৈর্য ধরুন আমরা কথা বলছি। দীর্ঘ প্রায় ৪৫ মিনিট অপেক্ষার পর সেনাবাহিনী আমাদের জানায় এখন আপনারা বিজয় মিছিল করতে পারেন। ওরা আর গুলি চালাবে না। এরই মধ্যে খালি হয়ে যায় প্রায় ১৪ টা মায়ের কোল। রক্তের ছোট ছোট ঝর্ণায় ধুয়ে যায় শহরের যত পাপ।

আমরা চূড়ান্ত মিজয় মিছিল শুরু করে দিলাম। মজমপুর গেট থেকে আমরা মিছিল নিয়ে গেলাম লাভলী টাওয়ার এর দিকে। সেখানে অনেকে মিষ্টি বিতরণ করলো। শহরের সমস্ত মানুষ তখন রাস্তায় নেমে এসেছে। মায়েরা আমাদের জন্য খাবার রান্না করে এনেছে। বোনেরা খাবার প্যাকেট বিলি করছে। আমিও নিলাম একটা প্যাকেট। ওটা না খেয়েই রেখে দিলাম আমার পকেটে। বড় ইচ্ছে করছিলো এই খাবারগুলো না খেয়ে রেখে দিই। খাবার, একটা গ্যাস লাইট, আর পেস্ট এগুলো যদি সারাটি জীবন আমার কাছে রেখে দিতে পারতাম কতই না ভালো হত!
শহরের প্রতিটা অলিতে গলিতে লোকে লোকারন্য। অনেক মাকে দেখলাম, তার কোলের বাচ্চা কে নিয়ে চলে এসেছে বিজয় মিছিলে। এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। খুবই ভালো লাগছিলো তখন। আমার মা বোনদের এই বিজয়ের আনন্দটা দেওয়ার জন্যই তো আমাদের লড়াই ছিলো। আমাদের আর দেখতে হবে না, বাবার সামনে মেয়ের ধর্ষণ। ভাইয়ের সামনে বোনের ধর্ষণ। স্বামীর কে বেঁধে রেখে স্ত্রী কে ধর্ষণ।
মিছিল এগিয়ে চলে চৌরহাস মোড়ের দিকে। সেখানে আমরা রাস্তায় মাগরিবের নামাজ আদায় করি।
এর পর আসি সদর হাসপাতালে। সেখানে আমার প্রথম সারির ভাইয়েরা সংবাদ সম্মেলন করতে চায। আমি তুহিনকে বললাম মোস্তাফিজুর কই? ও তো প্রধান স্বমন্বয়ক। তুহিন জানালো, ওকে ডাকবো না। মোস্তাফিজুর কোন কাজ করে নাই। ও শুধু আন্দোলনের ডাক দিয়ে লুকিয়ে থেকেছে। ওরে খুঁজে পাওয়া যায় নাই। সব তো আমরা করলাম। আমরাই সংবাদ সম্মেলন করবো। আমি বললাম, ভালো। সংবাদ সম্মেলনে আহত ও মৃত এর সংখ্যা জানানো হয়।

অতপর রাতে বন্ধু সাব্বির আমাকে আর তুহিনকে জানায়, তার আপার বাসায় খাওয়ার ব্যবস্থা করেছে। সেখানে খেতে হবে। আমরা রাতে ওর আপার বাসায় চলে যাই। যাওয়ার পথে দেখি প্রতিটা গলিতে আনন্দ উৎসব করছে মুক্তিপাগল জনতা। আপার বাসায় খেয়ে আমরা চলে আসি আবার সদর হাসপাতালে। সেখানে আহতদের কি কি সাহায্য লাগবে? তাদের দেখভাল ঠিকমত হচ্ছে কিনা সেটা দেখে আসি। পরে তাদের সাহায্যের জন্য তুহিন টাকার বিষয়ে কথা বলে। আমাদের সবার পরিচিত জনদের কাছে টাকার জন্য সাহায্য চাওয়া হয়।
সেখানে আমার প্রিয় একজন মানুষ কবি রাফিকুল ইসলাম কালবির সাথেও দেখা হয়। তাকে সাহায্যের বিষয়ে বললে সেও সাহায্যের জন্য আশ্বাস দেয়।
রাতে ঘুমানোর জন্য চলে আসি আমার ভাতিজা আমির হামজার কাছে।
পরের দিন সকালে আমি আর তুহিন চলে আসি জোতপাড়া সবুজা আপার বাসায়। আপার সাথে দেখা করে আগের দিনের ভেজা প্যান্ট আর ভেজা গেঞ্জি গায়ে চলে আসি বাড়ি।
একজন যোদ্ধা আমি, মায়ের সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার যোদ্ধা ছেলে। মায়ের মুখের দিকে তাকালে, মা মুক্তা ঝড়া হাসি দিয়ে আমাকে জড়িয়ে নিল তার বুকে। মায়ের চোখের পানি গড়িয়ে পড়ছে আমার কাঁধে। নাহ! এটা কোন কষ্টের অশ্রু নয়। এটা আনন্দাশ্রু। বিজয়াশ্রু।