চুয়াডাঙ্গার ডিঙ্গেদহ বাজারের নিকটবর্তী কৃষকের চাষযোগ্য জমি অধিগ্রহণ করে তৈরি করা হয়েছিল বিসিক শিল্পনগরী। উদ্দেশ্য ছিল শিল্পনগরীর মাধ্যমে উদ্যোক্তাদের সহযোগিতা করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও স্থানীয় তথা দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখা। তবে প্রতিষ্ঠার সাড়ে চার বছরেও চুয়াডাঙ্গার বিসিক শিল্পনগরীতে মাত্র দুটি কারখানা খুবই সীমিত উৎপাদন শুরু করতে পেরেছে। আর উদ্যোক্তাদের আগ্রহ না থাকায় ৭৮টি প্লটের মধ্যে এখনো বরাদ্দের বাইরে রয়ে গেছে ৫০টি। অর্থাৎ মোট প্লটের ৬৪ শতাংশের বেশি প্লট বরাদ্দ নেয়ার উদ্যোক্তা পাওয়া যায়নি। ফলে বিসিকের প্রায় ৪২ কোটি টাকা ব্যয়ের এ প্রকল্পের লক্ষ্য বাস্তবায়ন নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
শিল্পোদ্যোক্তারা বলছেন, ভূমি উন্নয়ন, জমির মূল্য, নিরাপত্তা, পয়োনিষ্কাশন, পানি সরবরাহসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধার অভাবে প্লটগুলোতে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে না। তবে বিসিক কর্তৃপক্ষ বলছে, শিল্পনগরীতে কারখানা গড়ে উঠতে ছয়-সাত বছর সময় লাগে। আর কৃষিনির্ভর জেলা হওয়ায় উৎপাদনমুখী ব্যবসার প্রতি স্থানীয়দের আগ্রহ কম।
২০২১ সালে চুয়াডাঙ্গা সদর উপজেলার ডিঙ্গেদহে ২৫ দশমিক ১২ একর জমিতে বিসিক শিল্পনগরী প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে ব্যয় হয় ৪১ কোটি ৯১ লাখ টাকা। বিসিক সূত্র জানায়, শিল্পনগরীটিতে ছয় ক্যাটাগরির ৭৮টি প্লট রয়েছে। প্রতি শতকের বিক্রয়মূল্য ২ লাখ ১০ হাজার টাকা ধরা হয়। চুয়াডাঙ্গার বিসিক শিল্পনগরীতে এ পর্যন্ত দুটি কারখানা সীমিত পরিসরে উৎপাদনে যেতে পেরেছে। তবে এখন আরো চার কারখানা তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। বরাদ্দ পাওয়া প্লটগুলোর অধিকাংশ শিল্পোদ্যোক্তা সেখানে কীটনাশক ও মিশ্র সার উৎপাদন, প্যাকেজিং এবং বিভিন্ন ধরনের বীজ ও আমদানি করা সার-কীটনাশক রিপ্যাকিংয়ের কথা জানিয়েছেন। এছাড়া যন্ত্রপাতি তৈরি, কেমিক্যাল উৎপাদন ও সরবরাহ এবং হালকা প্রকৌশল কারখানা তৈরিরও কথা রয়েছে।
গত বছরের সেপ্টেম্বরে বিসিক সারা দেশের অবরাদ্দকৃত প্লটগুলো বরাদ্দের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেয়। সে সময়কার বিজ্ঞপ্তিতে চুয়াডাঙ্গার শিল্পনগরীর ৫৩টি প্লট বরাদ্দের কথা বলা হয়। তবে বিজ্ঞপ্তির পর চুয়াডাঙ্গার শিল্পনগরীর মাত্র তিনটি প্লট বরাদ্দ দেয়া গেছে।
সরজমিনে দেখা যায়, ঘাস আর জঙ্গলে ছেয়ে গেছে পুরো শিল্পনগরী। এমনকি ড্রেনগুলোও ভরে গেছে লতাপাতায়। গোটা এলাকা সুনসান। শিল্পনগরীর দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তের একটি কারখানায় কিছু মানুষের দেখা পাওয়া যায়। চারটি প্লটে কারখানা নির্মাণসামগ্রী পড়ে থাকতে দেখা যায়।
চুয়াডাঙ্গা শিল্পনগরীতে সীমিত পরিসরে উৎপাদন শুরু করেছে সাজেন্টাস নামের একটি সার উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। বিসিকের বিরুদ্ধে অব্যবস্থাপনার বিস্তর অভিযোগ এনে সাজেন্টাসের ম্যানেজার সাজ্জাদ হোসেন বলেন, ‘বিসিক কর্মকর্তাদের অবহেলার কারণে উদ্যোক্তারা শিল্পনগরীর সুফল পাচ্ছেন না। এখানকার ড্রেনেজ ব্যবস্থা ও রাস্তাঘাট ভালো নয়। বৃষ্টি হলেই পানি জমে যায়। ঘাস-লতাপাতায় ড্রেনগুলো নষ্ট হয়ে গেছে। প্লট বরাদ্দ নেয়ার সময় মাটি ফেলে উঁচু করে দেয়ার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। ব্যবস্থা করে দেয়নি পানিরও। এসবই নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় করতে হয়েছে। কোনো ধরনের সেবা না পেলেও ছয় মাস পরপর আমার প্রতিষ্ঠানকে ২৫ হাজার টাকা করে সার্ভিস চার্জ দিতে হয়। শিল্পনগরীর নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ভালো নয়। ভেতরটি ঘন জঙ্গলে ছেয়ে গেছে। সেখানে মাদকসেবীরা আড্ডা দেয়। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। এমন বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণে বাইরের উদ্যোক্তারা এখানে কারখানা করতে আগ্রহী হয়নি।’
সাজ্জাদ হোসেন আরো বলেন, ‘প্লটগুলো অনেক নিচু। তার তুলনায় জমির দাম কিছুটা বেশি। এরপর মাটি ভরাট করে উঁচু করতে গিয়ে আরো খরচ আছে। আমাদের ১৮ শতাংশের প্লটটি ভরাট করতে এ পর্যন্ত দেড়শ গাড়ি মাটি কিনতে হয়েছে। এতে এরই মধ্যে সোয়া দুই লাখ টাকা খরচ হয়েছে, এখনো দেড় লাখ টাকার মাটি লাগবে। এত খরচ, কিন্তু পানি, গ্যাস কিছুই নেই। বিদ্যুতের ব্যবস্থাও নিজেকেই করতে হয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র পেতেও ভোগান্তি আছে। এসব সমস্যা মোকাবেলা করে উদ্যোক্তারা কেন সেখানে কারখানা করবে?’
শিল্পনগরীতে নতুন কারখানা স্থাপন করছে কিষাণ অ্যাগ্রো কেমিক্যালস লিমিটেড। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক মো. ফেরদৌস আলম বলেন, ‘আমরা এখানে কী সুবিধা পাব সেগুলো এখনো জানি না। মাটি ভরাট করে দেয়ার কথা থাকলেও কর্তৃপক্ষ তা দেয়নি। অনেক টাকা খরচ করে নিজেরাই মাটি ভরাট করে কারখানা তৈরির কাজ শুরু করেছি। বৃষ্টি হলে জলাবদ্ধতাসহ আরো কিছু সমস্যা আছে। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ততটা গড়ে ওঠেনি। একবার প্রাচীরের নিচ দিয়ে চোর গর্ত খুঁড়েছিল। পরে নিজের টাকায় সেই গর্ত বন্ধ করেছি।’
তবে পিএসপি নামের একটি স্টিনলেস স্টিল কারখানার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) অপু কুমার সাধু খাঁ জানান, বিসিকের প্রধান কার্যালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ থাকায় কারখানা নির্মাণে ভালো সহযোগিতা পাচ্ছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘এখানে আমরা কারখানা তৈরির কাজ শুরু করেছি। এখনো তেমন সমস্যায় পড়িনি। রাস্তাঘাট ও ড্রেন নিয়ে একটু সমস্যা আছে। তবে এখানে বিনিয়োগ করলে ভালো কিছু হবে বলে আশাবাদী।’
বিষয়টি নিয়ে বিসিক চুয়াডাঙ্গা জেলা কার্যালয়ের উপব্যবস্থাপক এবিএম আনিসুজ্জামানের সঙ্গে কথা হয় বণিক বার্তার। তিনি বলেন, ‘বিসিক শিল্পনগরীর পুরোপুরি চালু হতে ছয়-সাত বছর লেগে যায়। এজন্য সংক্ষিপ্ত সময়ে স্থানীয় অর্থনীতিতে বিসিকের অবদান দেখা যায় না। চুয়াডাঙ্গা কৃষিনির্ভর অঞ্চল হওয়ায় এখানকার মানুষ উৎপাদনমুখী ব্যবসার চেয়ে কৃষিপণ্য ক্রয়-বিক্রয়ের ব্যবসা বেশি করে। সেজন্য স্থানীয় উদ্যোক্তার অভাবে এখনো সব প্লট বরাদ্দ দেয়া যায়নি। ছয়টি কারখানা তৈরির কাজ শুরু হয়েছে।’
প্লট বরাদ্দ নেয়া উদ্যোক্তাদের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, ‘শিল্প-কারখানা করার মতো সব সুযোগ-সুবিধা দিয়েই শিল্পনগরী স্থাপন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ, পানি ও ড্রেনেজের ব্যবস্থা রয়েছে। চুয়াডাঙ্গায় গ্যাসের পাইপলাইন প্রবেশ করেনি, সেজন্য শিল্পনগরীতে গ্যাসের ব্যবস্থা নেই। শিল্পনগরীর পাশেই হাইওয়েসংলগ্ন নিচু জমি কাঁঠাপ্রতি ৬-৮ লাখ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আমরা কাঠাপ্রতি ৩ লাখ ৪৬ হাজার টাকা নিচ্ছি। জমির দাম পরিশোধ করতে পারছে না—এমন পুরুষ উদ্যোক্তাদের ছয় বছর এবং নারী উদ্যোক্তাদের সাত বছরের কিস্তিতে মাত্র ৫ শতাংশ ইন্টারেস্টে প্লট দিচ্ছি। প্লট সাধারণত রাস্তা থেকে একটু নিচু হয়। সময়ের পরিক্রমায় এখানকার ভরাট করা মাটি কিছুটা দেবে গেছে। এটি নিয়ে উদ্যোক্তাদের অভিযোগ অহেতুক।.।।
নিরাপত্তার বিষয়ে এবিএম আনিসুজ্জামান বলেন, ‘চুয়াডাঙ্গায় আমার দেড় বছর কর্মকালে এখন পর্যন্ত নিরাপত্তাহীনতার কোনো ঘটনা দেখিনি। কারখানাগুলো চালু হয়ে গেলে নিরাপত্তারক্ষীরা বিসিক শিল্পনগরীতে ২৪ ঘণ্টা পাহারা দেবে।#