গত বছরের ৫ই আগস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হলেও রুপ পাল্টিয়ে নিজের অবস্থান ধরে রাখছেন বেশ কিছু সুবিধাবাদি কর্মকর্তা - কর্মচারীরা, ঠিক এমননিই একজন দুর্নীতিবাজ কমান্ড্যান্ট শহীদউল্লাহ, জিনি বিগত সৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বাংলাদেশ রেলওয়ে কমলাপুর থাকার সুবাদে বিভিন্ন প্রকার ঘুষ দুর্নীতি এবং জাল জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছেন শতকোটি টাকার মালিক, গত কয়েক মাস আগে নিজের পিট বাঁচাতে বদলি হয়ে চট্রগ্রাম গেলেও আবারো ঢাকায় ফিরতে মরিয়া এই দুর্নীতিবাজ (আর এনবি) কর্মকর্তা কমান্ড্যান্ট শহীদউল্লাহ,বাংলাদেশ রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরএনবি) দুর্নিতিবাজ কমান্ড্যান্ট শহীদউল্লাহ চট্রগ্রাম থেকে রাজধানী ঢাকায় বদলী হওয়ার জন্য সরকার কর্তৃক রেলপথ মন্ত্রণালয় মনোনীত ছাত্র সমন্বয়কদের ১০ লক্ষ টাকা ঘুষ প্রস্তাব করেছেন। বর্তমানে ঢাকায় কর্মরত কমান্ড্যান্ট শফিকুল ইসলামকে টেলিফোনে একথা বলেন রেলপথ মন্ত্রণালয় মনোনীত ছাত্র সমন্বয়কদের একজন মেহেদী হাসান। কমান্ড্যান্ট শহীদউল্লাহকে ব্যাপক দুর্নিতির অভিযোগে কয়েকমাস আগে ঢাকা থেকে চট্রগ্রামে বদলী করা হয়।
বিগত স্বৈরাচার হাসিনা সরকার আমলের প্রায় পুরোটা সময় ঢাকায় থেকে বহুমুখী দুর্নিতি করে রেল বিভাগ থেকে শত শত কোটি টাকা লুটেছেন এই শহীদউল্লাহ। ক্ষমতার পালাবদলে তাকে চট্রগ্রামে বদলী করা হলেও আবারো ঢাকায় বদলী হতে ছাত্র সমন্বয়কদের ১০ লক্ষ টাকা ঘুষের প্রস্তাব দেন। কলরেকর্ড থেকে বোঝা যাচ্ছে, চট্রগ্রামের রেলওয়ে নিরাপত্তাবাহিনীর কমান্ড্যান্ট শহীদুল্লাহ শহীদ এর কাছ থেকে ১০ লক্ষ টাকার বিনিময়ে তাকে ঢাকায় নিয়ে আসার পায়তারা করছে এই দুই ছাত্র প্রতিনিধি মেহেদী হাসান এবং রেজাউল করীম। তাদের তিনজনের কথোপকথনের একটি কল রেকর্ড প্রতিবেদকের কাছে সংরক্ষিত আছে।
রেকর্ডটিতে শোনা যায়, ঢাকার নতুন কমান্ড্যান্ট শফিকুল ইসলাম কথা বলছেন ছাত্র প্রতিনিধি মেহেদী হাসানের সাথে, ‘আমি তো ওইদিন আপনার সামনেই বললাম কোর্টের মধ্যে থেকে যে টাকাটা জমা হয় ওইটা তোলার জন্য। ওইটা না হলে দুই লাখ টাকা দিতে পারবো না, আমার কোন ইনকাম সোর্সও নাই।
মেহেদী বলছে, এদিকে যারা ক্ষমতাশালী তারা তো টাকা পয়সা কামাইছে, বোঝেন না প্রেসার।
মিস্টার ইসলাম বলছে, আমি তো বলছি শহীদুল্লাহ শহীদ যেহেতু বলছে তার কাছ থেকে দশ লাখ টাকা নিয়া নেন। এই গাদ্দারের সাথে তো গাদ্দারি করতে সমস্যা নাই। করলে করবেন কাজ। না করলে না করবেন। সে মাত্র গেছে। এখন আবার যদি সে মনে করে ৬ মাসের মধ্যেই তার ফিরতে হবে।’
ঢাকায় থেকে যেভাবে শহীদউল্লাহ যাত্রীদের হয়রানি আর স্বর্ন ও মাদক চোরাচালানে সহায়তা করে অবৈধ পন্থায় টাকা কামাতে পারতেন সেটা এখন চট্রগ্রামে পারছেননা। তাছাড়া ঢাকায় তার দুর্নিতির শাখা-প্রশাখা নিজের বানানো। ঢাকায় অবৈধ ইনকামের সুযোগও বেশি। তাই পুরনো জায়গায় বদলী হয়ে আসতে পারলে শহীদউল্লাহর দুর্নিতি করতে আর কোন বেগ পেতে হবেনা।
আওয়ামী লীগ সরকার আমলে শহীদউল্লাহর দুর্নিতি ও শত কোটি টাকার সম্পদ নিয়ে ৫ জুলাই ২০২৪ ইং এ প্রথম সংবাদ প্রকাশ হয় দৈনিক ইত্তেফাকে। কিন্তু ঐ সময় হাসিনা সরকার বিরোধী আন্দোলনের তুমুল জোয়ারে প্রতিদিনের গণহত্যার সংবাদে ধামাচাপা পড়ে যায় শহদিউল্লাহর সংবাদটি। ছাত্র সমন্বয়ক মেহেদী ও কমান্ড্যান্ট শফিকুল ইসলামের কল রেকর্ড সংবাদমাধ্যমের হাতে আসলে ফের আলোচনায় আসে শহীদউল্লাহ।
অনুসন্ধানে জানা যায় ৫ আগস্টের পর ব্যাংক থেকে প্রায় ৬৫ লক্ষ টাকা উত্তোলন করেন শহীদউল্লাহ। হাসিনা সরকারের সাবেক রেলমন্ত্রী মুজিবুল হকের ভাগ্নি জামাই হিসেবে ব্যাপক পরিচিত শহদিউল্লাহ শহীদ ঢাকার কমলাপুর স্টেশনে কর্মরত থাকাকালীন দেদারসে দুর্নিতি করেছেন । গ্রামের বাড়ী মুজিবুল হকের সংসদীয় এলাকা চৌদ্দগ্রামের চিওড়াতে। মুজিবুল হকের আরেক ভাগ্নে মজিদ ছিলেন কমলাপুর রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। বর্তমানে বরিশাল পুলিশে বদলি আছেন। কমলাপুর থানার তৎকালীন ওসি মজিদের সাথে একজোট হয়ে স্বর্ন আর মাদক পাঁচারে মগ্ন ছিলেন কমান্ড্যান্ট শহাদউল্লাহ।
অনুসন্ধানে জানা যায়, মুজিবুল হকের ভাগ্নে মজিদ আর ভাগ্নি জামাই শহীদউল্লাহ দুজনে মিলে স্বর্ন আর মাদক চোরাচালানের স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন কমলাপুর ও বিমানবন্দর রেলস্টেশনকে। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে চোরাই স্বর্ন আর মাদক এয়ারপোর্ট স্টেশনে এসে কমান্ড্যান্ট শহীদউল্লাহর নেতৃত্বে ট্রেনে করে চোরাচালানীদের কাংখিত গন্ত্যব্যে পৌঁছে যেতো। যেসব চোরাচালানীরা তাদের নিয়মিত মোটা অংকের বখরা দিতো তাদের অবৈধ পন্য কখনোই আটক করতোনা আরএনবি ও থানার পুলিশ সদস্যরা। আর যারা মোটা অংকের টাকা ঘুষ না দিতো তাদের মাল আটক করে প্রেস কনফারেন্স এর মাধ্যমে নিজের সততা জানান দিতো শহীদউল্লাহ ও ওসি মজিদ। স্বর্ন আটকেও ছিলো বিশাল অংকের ইনকাম। যদি ৩০০ পিস স্বর্নের বার ধরা পড়তো ওসি মজিদ আর কমান্ড্যান্ট শহীদউল্লাহ সাংবাদিকদের জানাতো ৩ বা ৪ পিস এর কথা। বাকীটা তারা লোপাট করে দিতো। এভাবে বছরের পর বছর শহীদউল্লাহ হাতিয়ে নিয়েছেন শত শত কোটি টাকা।
অবৈধ এই ইনকাম দিয়ে শহীদউল্লাহ গড়েছেন ব্যাপক ভূ-সম্পত্তি। তার বিরুদ্ধে ৩ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগও উঠেছে। সিপাহি নিয়োগে দুর্নীতি ছাড়াও ঢাকায় ৫টি ফ্ল্যাট, কুমিল্লায় ৩০ বিঘা জমি, শাশুড়ির নামে ঢাকার অভিজাত এলাকায় ফ্ল্যাটও কিনেছেন বলে অনুসন্ধানে জানা যায়। বিগত সরকারের শেষ সময়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এসব বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছিলো। ঢাকার দুর্নীতি দমন কমিশনের সহকারী পরিচালক ও অনুসন্ধান কর্মকর্তা মো. মনোয়ারুল একটি গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছিলেন। গণমাধ্যমকে মনোয়ারুল বলেছিলেন, বাহিনীতে নিম্নমানের ইউনিফর্ম দিয়ে তিন কোটি টাকা আত্মসাৎ ও বিভিন্ন দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার সম্পদ অর্জনের বিষয়ে আরএনবির কমান্ড্যান্ট শহীদউল্লাহর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে। আমরা ইতিমধ্যে চিঠিও ইস্যু করেছি।
গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছিলো, ২৭ জুলাই ২০২৪ দুদক থেকে ইস্যু করা চিঠিতে শহীদ উল্লাহর বিরুদ্ধে ৮টি অভিযোগের ওপর নথিপত্র চায় দুদক। এর মধ্যে ২০২২-২৩, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের ইউনিফর্ম, বুট, মোজা, রেইনকোট, ফগার মেশিন, হ্যান্ড মাইক বিতরণ সংক্রান্ত কাগজ, আরএনবির বিভিন্ন মালামাল ক্রয়ের কাগজসহ ৮টি বিষয়। এর মধ্যে ৩টি বিষয়ে নথিপত্র পেয়েছে দুদক। দুদক সূত্র বলছে, ঢাকার শান্তিনগরে অবস্থিত রূপায়ণ টাওয়ারের তৃতীয় তলায় শাশুড়ির নামে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন শহীদউল্লাহ। শাশুড়ির কোনো আয়ের উৎস নেই। যেদিন থেকে কিনেছেন ঐদিন থেকেই স্ত্রী-সন্তানসহ সেখানে থাকেন শহীদউল্লাহ। ঢাকা মহানগরে রাজারবাগ পুলিশ লাইনস সংলগ্ন শান্তিনগরের রূপায়ণ টাওয়ারের তৃতীয় তলার এই ফ্ল্যাটের দাম প্রায় তিন কোটি টাকা। ওই ফ্ল্যাটের পাশেই রয়েছে তার মালিকানাধীন ছয়তলা একটি ভবন। ঢাকার উত্তরায় তিনটি, রাজধানীর মুগদাপাড়ায় আরও দুটি প্লট এবং কুমিল্লায় ঢাকা কুমিল্লা হাইওয়ের পাশে ৩০ বিঘা জমি কিনেছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে শহীদ উল্লাহর বিরুদ্ধে।
বর্তমানে পরিবর্তিত প্রেক্ষাপটে দুদককে ম্যানেজ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন শহীদউল্লাহ। রেল কর্মকর্তাদের মাঝে গুঞ্জন আছে এর আগে যখন দুদক তার নথিপত্র নিয়ে তদন্ত শুরু করে তখন তদন্ত কর্মকর্তাদের বিপুল অংকের টাকা দিয়ে তদন্ত ধামাচাপা দেন শহীদউল্লাহ।