আশিক ইসলাম (নিজ জীবনের সত্য কাহিনি অবলম্বনে)
সময়টা ২০১৫ সালের ১৮ই ডিসেম্বর, এক প্রচণ্ড শীতের শুক্রবারে রাত।
আমার মনটা বড় অস্থির হয়ে উঠেছিল।
অকারণে অস্থিরতা, এক অজানা শূন্যতা বুকের মধ্যে জমে ছিল।
শীতের রাত্রির একাকিত্ব যেন আরও বাড়িয়ে দিচ্ছিল সেই ভেতরের ফাঁকা জায়গাটা।
আর আমি তখন থাকতাম নানুর বাড়িতে।
আমার ছোট ভাই তখন মাত্র ৩৭ দিনের।
মা সংসারের সব কাজ, দর্জির কাজ, আর ছোট ভাইয়ের যত্ন—সব কিছু সামলাচ্ছিলেন একাই।
তবুও মুখে সবসময় হাসি লেগে থাকত।
সেদিন আমি বাসা থেকে নানুর বাড়ি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।
ব্যাগ গুছিয়ে মাকে বললাম,
“মা, ভাড়ার টাকা লাগবে।”
মা তাঁর কাজের টেবিল থেকে উঠে গেলেন ছোট্ট একটা পুরনো ড্রয়ারের দিকে।
অনেক খোঁজাখুঁজি করে একটা ভাঁজ পড়া পুরনো পঞ্চাশ টাকার নোট বের করলেন।
টাকাটায় লেগে ছিল দর্জির সুতো, সেলাইয়ের শব্দ, ঘামের ঘ্রাণ—আর ছিল মায়ের হাতের গন্ধ।
টাকা দেওয়ার পর মা বললেন,
“চল, তোকে অটোতে তুলে দেই।”
এমনটা মা কখনোই করতেন না।
রাস্তায় আসা তো দূরের কথা, দরজায় দাঁড়িয়ে হাত নাড়ানোই ছিল তাঁর বিদায়ের অভ্যাস।
কিন্তু সেদিন?
মা আমার পিছু পিছু এলেন রাস্তা পর্যন্ত।
অটোতে তোলে দেওয়ার সময় মায়ের চোখে ছিল এক অদ্ভুত ধরনের মায়া।
কণ্ঠে কাঁপা একটা দয়া মেশানো কণ্ঠস্বর:
“নানুর বাড়ি গিয়া ফোন দিবি কিন্তু… না হলে চিন্তা করুম।”
আমি কিছু বলার আগেই অটো চলতে শুরু করল।
মায়ের চোখ, মায়ের সেই শেষ কথাগুলো—আজও আমার কানে বাজে।
অটোতে বসেই হঠাৎ আমার গা দিয়ে ঘাম বের হতে লাগল।
ভেতরটা কাঁপতে লাগল। বুকটা ভার হয়ে এলো।
কোনো কারণ ছাড়াই যেন কষ্টে দম বন্ধ হয়ে আসছিল।
নানুর বাড়িতে পৌঁছে আমি একদম বিছানায় পড়ে গেলাম।
নানু, মামা, মামানি সবাই ছুটে এলেন।
“তোর কী হইছে রে? এই রকম করতেছিস কেন?”
“আমি জানি না নানু… ক্যান যানি আমার বুকটা ধড়ফড় করতেছে, খুব কষ্ট লাগতেছে ভিতরে…”
ওরা আমার মাথায় পানি দেয়, হাত-পা টিপে দিল…
কিছুতেই আমার শান্তি আসছিল না।
ঠিক তখনই বাইরের উঠানে বাবার সাইকেলের চেনের ঘুরঘুর শব্দ পেলাম।
বাবা এসে দাঁড়ালেন, মুখটা পাথরের মতো কঠিন।
কোনো কথা নেই, কোনো বার্তা নেই—কিন্তু চোখের কোণে লুকোনো কান্না।
ঠিক তখনই বাবার ফোনটা বেজে উঠল।
বাবা রিসিভ করলেন।
ওপাশ থেকে চাচার কণ্ঠে ভেসে এল —
“ভাই… ভাবি আর নেই।”
মুহূর্তেই যেন সবকিছু থেমে গেল।
সময় থেমে গেল।
আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না…
এইমাত্র মা আমাকে অটোতে তুলে বললেন,
“ফোন দিবি…”
সেই মা আর নেই?
তাঁর মুখে ছিল ছেলের ফোনের অপেক্ষা…
কিন্তু আমি ফোন করিনি।
আমি চুপচাপ পকেট থেকে সেই পঞ্চাশ টাকার নোটটা বের করলাম।
একটু ভাঁজ করা, একটু পুরনো…
কিন্তু টাকাটায় গায়ে লেগে ছিল মায়ের গন্ধ, মায়ের স্পর্শ, আর এক সমুদ্র না বলা ভালোবাসা।
মায়ের দাফনের সময়, যখন সবাই কান্নায় ভেঙে পড়েছিল, আমি তখন এক কোণে চুপচাপ দাঁড়িয়ে ছিলাম।
মা আমার জীবনের এমন একটা জায়গা দখল করে ছিলেন—
যেটা হারিয়ে গেলে কোনো কিছুতেই সেই শূন্যতা পূরণ করা যায় না।
মায়ের কবর থেকে ফেরার সময় আমি বুকপকেটে হাত দিতেই বুঝলাম—
সেই পঞ্চাশ টাকা তখনো আমার সঙ্গে।
মনে হচ্ছিল, এই টাকাটার চেয়ে দামী কিছু নেই এই দুনিয়ায়।
এটা দিয়ে কিছু কেনা যাবে না,
কারণ এটা মায়ের শেষ ছোঁয়া।
আজও আমি সেই পঞ্চাশ টাকার নোটটা একটা পুরনো কৌটায় তুলে রেখেছি।
মা নেই,
তবু সেই টাকায় এখনো মা বেঁচে আছেন।
আর এখনো, এত বছর পরও, ঘরের এক কোণে রাখা আছে মায়ের চালানো সেই পুরনো সেলাই মেশিনটা।
যেটার শব্দে চলত আমাদের সংসার।
সেই শব্দ আর শোনা যায় না—
তবুও মেশিনটার পাশে দাঁড়ালে মনে হয়,
মা যেন ঠিক এখানেই কোথাও আছেন…